যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক মারিয়াম মাহদিয়ার জন্ম ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে। তবে তাঁর মায়ের পরিবার ছিল ব্যাপ্টিস্ট। ফলে উভয় ধারার রীতিনীতি ও বিশ্বাস খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান তিনি। খ্রিস্ট ধর্মের দুটি ধারার পার্থক্য তাঁর মনে বহু প্রশ্নের জন্ম দেয়। একসময় তিনি ধর্মবিমুখ হন। আত্মিক প্রশান্তির খোঁজে একসময় বৌদ্ধ ধর্মমতও গ্রহণ করেন। কিন্তু তাতেও স্থির হতে পারেননি মাহদিয়া। শেষ পর্যন্ত এক মিসরীয় মুসলিম যুবকের সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয়ের পর ইসলামের সংস্পর্শে আসেন এবং ১৯৯২ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের বিবরণ নিম্নরূপ—

স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস যেভাবে হারিয়ে যায় : আমি ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে বেড়ে উঠি এবং ‘ক্যাথলিক অ্যালিমেন্টরি’ স্কুলে পড়ি। সেখানে প্রতিটি ধাপ ছিল একজন আদর্শিক ক্যাথলিক হয়ে ওঠার সিঁড়ি। এক গ্রীষ্মে আমি দক্ষিণাঞ্চলে নানাবাড়ি যাই। আমার নানা সে সময় একজন ‘ব্যাপ্টিস্ট মিনিস্টার’ ছিলেন। নানাবাড়িতে চার্চ ও বাইবেল স্কুলে যেতাম এবং খ্রিস্ট ধর্মীয় সংগীত গাইতাম। আমার ধর্মীয় জীবনও ছিল দুই রকম। আমার কাছে তা ছিল দুটি ভিন্ন পৃথিবী। তবে পারিবারিক সমস্যার কারণে একসময় স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। অবশেষে খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাস থেকে আমি পুরোপুরি সরে আসি। কেননা এ ধর্মের বহু কিছু আমার কাছে বোধগম্য ছিল না।

যেভাবে বৌদ্ধ ধর্ম থেকে বিশ্বাস হারিয়ে : ২০ বছর বয়সে আবারও ধর্মমুখী হই। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। একসময় তা গ্রহণ করলাম এবং মানসিক প্রশান্তি লাভে তা আমাকে নানাভাবে সাহায্য করছিল। তবু কোনো কিছুর শূন্যতা রয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিল। কয়েক বছরের মধ্যে আমি বৌদ্ধ ধর্ম থেকে বিমুখ হয়ে গেলাম। এরপর ব্যাবসায়িক কাজে আমি মিসরে যাই। সেখানে আমার স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সে বলত, তোমাকে মুসলিম হতে হবে না, তুমি শুধু স্রষ্টায় বিশ্বাস কোরো। আমি বাহ্যত তার কথার প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু মনের ভেতর ঠিকই একটি জানালা খুলে গিয়েছিল।

স্বামীর মাধ্যমে ইসলামের পথে : আমার স্বামী এক বন্ধুকে বলল, আমাকে যেন ইসলামবিষয়ক কিছু বই এনে দেয়। বইগুলোর ব্যাপারে আমার আগ্রহ বেড়েছিল; কিন্তু আমি তাকে প্রশ্রয় দিলাম না। বইগুলো এক পাশে রেখে ঘুমাতে গেলাম।

যে স্বপ্ন বদলে দেয় জীবনচলা : সে রাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখি। চারপাশে ঝলমলে বাতি। পেছনে সুমধুর কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত হচ্ছে। আমি একজন শায়খের চেহারা দেখলাম। তিনি সাদা রুমাল পরে আছেন। আমার পেছনে একটি স্বর্ণালি রঙের পেঁচানো সিঁড়ি। এমন উজ্জ্বল আলো আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু আলো আমার চোখে লাগছিল না। নিখাদ স্বর্গীয় দৃশ্য। আমি নিজেও সাদা মুসলিম পোশাক পরে ছিলাম, মাথা ঢেকে রেখেছিলাম। আমার ভেতর আনন্দ ও শুভ্র আলোতে ভরা ছিল। আমার সামনে ছিল পাঁচ-ছয় বছরের একটি শিশু। কিন্তু সে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকায় চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমি জানি সে আমার সন্তানই ছিল।

ইসলাম বিষয়ে গভীর পাঠ : এই স্বপ্ন আমার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ঘুম ভাঙার পরও যেন স্বপ্নে ডুবে ছিলাম। যদিও আমার কাছে তার বিশেষ কোনো অর্থ ছিল না, তবু স্বামীকে আমি সেটা বললাম। সব শুনে সে বলল, এমন স্বপ্ন প্রত্যেক মুসলমানের প্রত্যাশা। কিন্তু এমন স্বপ্ন আমি কেন দেখলাম? সে বলল, স্রষ্টা আমাকে এই স্বপ্নের মাধ্যমে কোনো বার্তা দিয়েছেন এবং আমি সত্যি ভাগ্যবান। স্রষ্টা আমাকে তাঁর কাছে টেনে নিতে চান। এই স্বপ্ন দেখার পর আমি ইসলামবিষয়ক বইগুলো পড়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও নিয়মগুলো পাঠ করলাম। কোনো সংকোচ ছাড়াই তা আমার বোধগম্য হলো। একজন নারী হিসেবে আমার অনুভূতি ছিল নারীর ব্যাপারে ইসলামের বক্তব্য প্রকৃত নারী সত্তার জন্য সত্য। আমি কোরআন পড়লাম। তা অসাধারণ স্থির ও প্রশান্তিতে ভরপুর। কোরআনের অনবদ্য যুক্তি এবং আমার ওপর তার প্রভাব দেখে আমি নিশ্চিত হই কোরআন মহান স্রষ্টারই বাণী।

আল আজহারে এসে নতুন জীবন শুরু : এরপর আমি নিজেকে ইসলামী আবহে নিমজ্জিত রেখেছিলাম। এরপর ছোট ছোট বিষয় ঘটতে থাকল, যা থেকে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয় স্রষ্টা আমার সঙ্গে আছেন। সবচেয়ে সুন্দর ঘটনা ছিল, আমি খুব সুন্দর একটি কন্যাশিশু লাভ করলাম। আমরা যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। কিন্তু মিসরে যাওয়ার আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করব। আমি মিসরে ফিরে এলাম, আল-আজহারে গেলাম এবং ঘোষণা করলাম, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল।’